• ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ | ৩ আশ্বিন ১৪৩১

Shongbad Protikshon || সংবাদ প্রতিক্ষণ

দুদককে ঢেলে সাজাতে চায় সংস্কার কমিশন

প্রকাশিত: ১৫:৩২, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪

দুদককে ঢেলে সাজাতে চায় সংস্কার কমিশন

দুদককে ঢেলে সাজাতে চায় সংস্কার কমিশন

‘দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) ঢেলে সাজাতে হবে। এ প্রতিষ্ঠানটিকে দলীয় প্রভাব এবং আমলাতন্ত্রের হাতে জিম্মিদশা থেকে মুক্ত করতে হবে। দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে দুদকের পাশাপাশি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বিএফআইইউ, সিআইডি- এসব প্রতিষ্ঠানেরও সংস্কার দরকার। রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতিরও পরিবর্তন হতে হবে’- এসব প্রস্তাব অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষিত দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের।


প্রতিদিনের বাংলাদেশকে তিনি বলেন, দুদককে কেন্দ্র করে আমরা খুবই নিবিড়ভাবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছি। দুদকের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আমরা এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত। এমনকি দুদকের যে মূল আইনটা সেটার খসড়াও টিআইবির করা। ২০০৪ সালে যখন প্রথম কমিশন (দুর্নীতি দমন কমিশন) গঠিত হয়, সেটা নিয়ে প্রথম গবেষণাটি আমি নিজে করেছিলাম। সেই থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত দুদক সম্পর্কে যেসব অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, তা থেকে বলতে পারি, আমাদের প্রথম যে বিষয়টি দেখতে হবে, সেটা হচ্ছে দুদকের নিজস্ব চ্যালেঞ্জ। দুদকের চেয়ারম্যান ও কমিশনার হিসেবে যারা নিযুক্ত হয়েছেন, তাদেরকে কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় সব সময় দলীয় রাজনীতি বিবেচনায় নিয়োগ করা হয়েছে। যাদেরকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তারা দলীয় রাজনীতির প্রভাবে প্রভাবিত। ফলে যারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন বা ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুদক কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। বরং যারা ক্ষমতার বাইরে এবং ক্ষমতাসীনদের প্রতিপক্ষ বা কোনো কারণে সরকারের রোষানলে পড়েছেন, তাদের জন্য লম্ফঝম্প হয়েছে। যার ফলে দুদকের যথাযথ কার্যকারিতা আমরা দেখতে পাইনি। কারণ দুর্নীতি করা হয় ক্ষমতাসীন অবস্থায়। দুর্নীতিবাজদের নিয়ন্ত্রণ করতে হলে ক্ষমতাসীন অবস্থায় করতে হবে। সেটা দুদক করতে পারেনি। কেন পারেনি সেটা পরিষ্কার। এই অবস্থা প্রতিহত করার উপায় আমাদের বের করতে হবে। দ্বিতীয়ত. দুদক আমলাতন্ত্রের হাতে জিম্মি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। সেখানে সরকারে সচিবসহ উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রেষণে পাঠানো হয়। তাদেরও দলীয় বিবেচনায় পাঠানো হয়। যার ফলে তাদের আনুগত্য দুদকের ভিশন-মিশনের প্রতি থাকে না। তারা আমলা এবং ক্ষমতাসীনদের আজ্ঞাবহ হিসেবেই কাজ করেন। এদের বিষয়টিও আমাদের দেখতে হবে। 

দুদকের নিজস্ব কর্মী বাহিনী সম্পর্কে তিনি বলেন, তাদের মধ্যে অনেকেই সৎ এবং তারা যথাযথভাবে কাজ করতে আগ্রহী। কিন্তু তাদেরকে কোণঠাসা করে রাখা হয়। অন্য যারা আমলা এবং ক্ষমতাসীনদের আজ্ঞাবহ তাদের সুযোগ-সুবিধা বেশি দেওয়া হয় এবং তারা এ সুযোগ-সুবিধা নিজেদের দুর্নীতির কাজে ব্যবহার করেন। এই যে পরিস্থিতি- এর সমাধান কীভাবে করা যায় সেটা আমাদের দেখতে হবে। 

ড. ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, দুদকের আইনটাকেও সময়োপযোগী করে ঢেলে সাজানোর দরকার আছে। কারণ এটি অনেক কাটাছেঁড়া করা হয়েছে। দুদকের ক্ষমতাকে খর্ব করা হয়েছে। সঙ্গে সম্পূরক আরও কিছু আইন আছে, যা দুদকের কাজের ওপর প্রভাব সৃষ্টি করে। যেমন মানি লন্ডারিং আইন, কর আইন, সিভিল সার্ভিস অ্যাক্টের কিছু ধারা- সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি তদন্তে পূর্বানুমতি- এসবের প্রতিকূলতা কীভাবে নিরসন করা যায় তা নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে। এগুলো ঠিক করতে না পারলে দুদককে সেভাবে কার্যকর করা যাবে না বলেই তার অভিমত। 

দুদক একা দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, উচ্চপর্যায়ের দুর্নীতি, দেশে-বিদেশে অর্থ পাচার- এগুলো নিয়ন্ত্রণে দুদকের পাশাপাশি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বিএফআইইউ, সিআইডি- এসব প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। দক্ষতা, নিরপেক্ষতা, দলীয় প্রভাবমুক্ত অবস্থার ঘাটতির কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাও সঠিকভাবে তাদের ভূমিকা পালন করতে পারেন না। দুদকের সঙ্গে সমন্বিত উদ্যোগও নিতে পারেন না। দুদকের পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠানের সম্পূরক সংস্কারও হওয়া দরকার। 

শুধু দুদক সংস্কারেই সুফল আসবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, যেসব সংস্কার প্রস্তাব উঠেছে তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা যদি একটি আদর্শ দুদক পেয়েও যাই, তারপরও দুদক কার্যকর হবে না যদি না আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও আমলাতান্ত্রিক সংস্কৃতির পরিবর্তন না হয়। রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রে দলীয়করণটাই মুখ্য হয়ে গেছে। দলীয়করণ-নির্ভর রাজনৈতিক চর্চা, দুর্নীতিকে সুরক্ষা দেওয়ার প্রবণতায় পরিবর্তন আসতে হবে। এই চর্চা ও প্রবণতা দুদককে অকার্যকর করে রাখার অন্যতম কারণ। কাজেই দুদকের সংস্কার কেবল দুদকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না রেখে এসব মৌলিক জায়গাতেও হাত দেওয়া দরকার। তা না হলে আমাদের প্রত্যাশিত লক্ষ্য অর্জন হবে না। আমাদের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের যে ভিশন- নতুন বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জনের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনের সংস্কারে জন্য যে কমিশন গঠন হতে যাচ্ছে, সে কমিশন এককভাবে এসব সংস্কার করতে পারবে না। অন্য সংস্কার কমিশনগুলোর সমন্বয়ে এটা করতে হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন বা এখনও আছেন, তাদের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও আলোচনা করে তাদের ভিশনটাও আমাদের জানতে হবে। গণমাধ্যমকর্মীসহ সব অংশীজনের মতামতও সংগ্রহ করতে হবে। 

সংস্কার কমিশনের দায়িত্ব পাওয়ার আগের প্রস্তাব 

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ২৮ আগস্ট টিআইবি ‘নতুন বাংলাদেশ’-এ গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধে ৫৫ দফা প্রস্তাব রাখে। এর মধ্যে ১০টি প্রস্তাব ছিল অনিয়ম-দুর্নীতি প্রতিরোধ ও অর্থ পাচার রোধের। 

প্রস্তাবগুলো হচ্ছে- দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) স্বাধীনতা ও সক্ষমতা নিশ্চিত করার জন্য দুদকের প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতাসহ জনবল নিয়োগ, পদায়ন ও বদলির ক্ষমতা দুদক সচিবের কাছ থেকে সরিয়ে কমিশনের হাতে ন্যস্ত করতে হবে। দুদকে পরিচালক থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন পদসমূহে প্রেষণের মাধ্যমে পদায়ন বন্ধ করতে হবে। দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচার বিষয়ে তদন্ত ও ব্যবস্থা গ্রহণে দুদকের ক্ষমতাকে নিশ্চিত করতে আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা সংশোধন করতে হবে (যেমন সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট, ২০১৮; মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ ও আয়কর আইন, ২০২৩)। দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান; যেমন দুদক, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়, অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়, ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টসহ (সিআইডি) সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয় প্রভাবমুক্ত ও পেশাগত দক্ষতার উন্নয়ন করতে হবে।

 দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের কার্যকর জবাবদিহির অনুকরণীয় উদাহরণ স্থাপনে দুদক, বিএফআইইউ, এনবিআর, সিআইডি ও অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়কে সম্পৃক্ত করে স্থায়ী টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। জনপ্রতিনিধিত্ব ও সরকারি কার্যক্রমে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ, স্বজনপ্রীতি ও অনিয়ম-দুর্নীতি প্রতিরোধে ‘স্বার্থের দ্বন্দ্ব আইন’ প্রণয়ন করতে হবে। ‘সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮’-তে সরকারি কর্মচারীদের ফৌজদারি মামলায় গ্রেপ্তারে সরকারের অনুমতি গ্রহণের বিধান (ধারা ৪১-এর ১) বাতিল করতে হবে। সকল পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী এবং সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের প্রধান/চেয়ারম্যান ও সদস্যসহ সব পর্যায়ের কর্মীদের প্রতিবছর তাদের আয় ও সম্পদের বিবরণ প্রকাশ করতে হবে। জাতীয় বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাতিল করতে হবে। সকল প্রকার সরকারি ক্রয়, প্রকল্প পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ‘ভ্যালু ফর মানি’ অর্জনে অন্তরায় ও অনিয়ম-দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করে এমন আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাসমূহ চিহ্নিত করে সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। অর্থ পাচার রোধে যে সকল দেশে অর্থ পাচার হয়েছে, সেই সকল দেশের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সাথে পারস্পরিক আইনি সহায়তা (মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স) কার্যকর করতে হবে। আমদানি-রপ্তানি, হুন্ডি, আর্থিক খাতে জালিয়াতি ও বেনামি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কৃত সকল অর্থ পাচার বন্ধ করতে হবে। বিশেষ করে বিএফআইইউ, এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংক, অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়, দুদক, সিআইডি, বাংলাদেশ পুলিশ ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে যোগসাজশমূলক চালান জালিয়াতিনির্ভর অর্থ পাচারের প্রক্রিয়া রুদ্ধ করতে হবে। দেশে-বিদেশে সকল আর্থিক লেনদেনের স্বচ্ছতা নিশ্চিতে ‘দ্য কমন রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড (সিআরএস)’-এর মাধ্যমে অনতিবিলম্বে আর্থিক লেনদেনের স্বয়ংক্রিয় তথ্যপ্রাপ্তির সুবিধায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। ব্যক্তিখাতের অধীন প্রতিষ্ঠানসমূহে মালিকানার স্বচ্ছতা নিশ্চিতে এবং খেলাপি ঋণ ও অর্থ পাচার রোধে ‘মালিকানার স্বচ্ছতা আইন (বেনিফিশিয়াল ওনারশিপ ট্রান্সপারেন্সি অ্যাক্ট)’ প্রণয়ন করতে হবে। দুর্নীতি প্রতিরোধে জনসম্পৃক্ততা জোরদার করার লক্ষ্যে গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।